কোডেক্স গিগাস – শয়তানের বাইবেল
অধ্যায়–১ : ভূমিকা ও ইতিহাস
ভূমিকা
মানব ইতিহাসে কিছু বই আছে যেগুলোকে ঘিরে রহস্য, কিংবদন্তি আর অজানা গল্প শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে মুগ্ধ করেছে। এইসব বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত, বিতর্কিত এবং ভয়াবহ বইটির নাম কোডেক্স গিগাস (Codex Gigas)। মধ্যযুগের এক বিশাল পাণ্ডুলিপি, যার ওজন প্রায় ৭৫ কেজি, উচ্চতা প্রায় এক মিটার, আর যার পাতার সংখ্যা ৩১০-এরও বেশি। বইটি শুধু আকারে নয়, এর ভেতরের বিষয়বস্তু ও ইতিহাসেও এক অনন্য রহস্য লুকিয়ে আছে।
এটিকে অনেকে "শয়তানের বাইবেল" বলে ডাকেন, কারণ এর ভেতরে এক সম্পূর্ণ পাতাজুড়ে আঁকা আছে এক ভয়ংকর দানবীয় প্রতিকৃতি—যাকে আমরা শয়তান বা লুসিফার হিসেবে চিনি। শুধু তাই নয়, বইটিকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে অগণিত লোককথা, গুজব আর রহস্যময় ঘটনার কাহিনী, যা একে ইতিহাসের সবচেয়ে অস্বাভাবিক পান্ডুলিপির আসনে বসিয়েছে।
উৎপত্তি
কোডেক্স গিগাস ১৩শ শতাব্দীর শুরুর দিকে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের পোডলাজিস (Podlažice) নামের এক ছোট্ট বেনেডিক্টাইন মঠে রচিত হয়েছিল। গবেষণা অনুযায়ী, এটি লিখেছিলেন একজন সন্ন্যাসী। তবে রহস্য এখানেই—এমন একটি বিশাল পান্ডুলিপি সাধারণত কয়েক ডজন লেখক, চিত্রশিল্পী ও কপিস্টদের সমন্বয়ে তৈরি হয়। অথচ কোডেক্স গিগাসে যে হাতের লেখা দেখা যায়, তা পুরো বই জুড়েই অভিন্ন—মানে, পুরো বইটি একজনই লিখেছেন।
এমন একটি পান্ডুলিপি হাতে লিখে শেষ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে ২০–৩০ বছর সময় লাগার কথা। কিন্তু কিংবদন্তি বলে, এটি মাত্র এক রাতেই লেখা হয়েছিল—আর এই অলৌকিক কাজ সম্ভব হয়েছিল শয়তানের সহায়তায়।
কিংবদন্তি: শয়তানের সাথে চুক্তি
মধ্যযুগীয় ইউরোপে একটি প্রচলিত গল্প শোনা যেত। বলা হয়, এক সন্ন্যাসী মারাত্মক অপরাধ করেছিলেন, যার শাস্তি ছিল জীবন্ত প্রাচীরের ভেতর সিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। মৃত্যুভয় থেকে বাঁচতে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি এক রাতের মধ্যে ঈশ্বরের মহিমা প্রচারের জন্য এক বিশাল পান্ডুলিপি লিখে ফেলবেন।
রাত বাড়তে থাকলে তিনি বুঝতে পারেন, কাজটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তখনই তিনি ঈশ্বরের পরিবর্তে শয়তানের কাছে সাহায্য চান। শর্ত ছিল—শয়তান তাকে এক রাতে বই লিখতে সাহায্য করবে, আর এর বিনিময়ে লেখক তার আত্মা শয়তানের হাতে সমর্পণ করবেন। শয়তান সম্মতি দেয় এবং কাজ শেষ হলে নিজের একটি বিশাল প্রতিকৃতি বইটির এক পাতায় আঁকতে বাধ্য করে। সেই কারণেই এই বই আজও পরিচিত "শয়তানের বাইবেল" নামে।
বাস্তব ইতিহাস
যদিও কিংবদন্তি গল্পকে রোমাঞ্চকর করে তুলেছে, তবে ইতিহাসবিদরা কিছু বাস্তব তথ্য খুঁজে পেয়েছেন—
- 
পান্ডুলিপিটি সম্ভবত ১২২৯ সালের কাছাকাছি সময়ে তৈরি হয়। 
- 
এটি Podlažice Monastery থেকে পরে বিভিন্ন মঠ ও প্রাসাদে স্থানান্তরিত হয়। 
- 
১৬৪৮ সালে ত্রিশ বছরের যুদ্ধের সময় সুইডিশ সেনারা প্রাগ দখল করলে বইটিকে লুট করে নিয়ে যায় এবং পরে এটি সুইডেনের স্টকহোম ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে স্থায়ীভাবে রাখা হয়। 
- 
এখনো এটি সেখানে সংরক্ষিত আছে, বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে। 
রহস্যময়তা
যা-ই বলা হোক, এই বইয়ের আকার ও বিষয়বস্তু একে সত্যিই রহস্যময় করে তুলেছে। এর পাতাগুলি তৈরি করা হয়েছে গাধার চামড়া থেকে (প্রায় ১৬০টিরও বেশি গাধার চামড়া লেগেছিল বলে অনুমান করা হয়)। পুরো পান্ডুলিপি লিখতে এবং সাজাতে একজন লেখকের এক জীবনের বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাওয়ার কথা।
তবুও এত বড় পান্ডুলিপি যদি সত্যিই একজন সন্ন্যাসী লিখে থাকেন, তবে তার প্রতিভা, ধৈর্য এবং মানসিক শক্তি মানব ইতিহাসের বিরলতম উদাহরণ। আর যদি কিংবদন্তি সত্যি হয়, তবে এটি শয়তানের সাথে মানুষের সবচেয়ে বড় চুক্তির এক নিদর্শন।
 
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন