রোজা রাখার উপকারিতা | রোজা রাখার ৭টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা

 


রোজা রাখার ৭টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা

হাজার হাজার বছর ধরে আমরা রোজা রেখে আসলেও এটা স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু ভালো বা খারাপ তা চিকিৎসাবিজ্ঞানে জানা ছিল না। তবে গত ২০-৩০ বছরের রোজা নিয়ে গবেষণা অনেক এগিয়েছে এবং কিছু আশ্চর্যজনক উপকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই পার্ট কিছু অসাধারণ রোজা রাখার কয়েকটি উপকারী তা নিয়ে আলোচনা করব। কিভাবে রোজা রাখলে উপকারিতা গুলো অনেক বেশি পাওয়া যায়।


 ১) তারুণ্য ধরে রাখা ও রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়া 


রোজার উপকারিতা সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমরা জানতে পেরেছি গত কয়েক দশকে। জাপানের একজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই বিষয়ে কাজ করে। আমাদের সারা শরীর ট্রিলিয়েন্ট ট্রিলিয়েন্ট কোষ দিয়ে গঠিত। এই কোষগুলো একেকটা ছোট ছোট কারখানার মত। এখানে সারাক্ষণ কাজ চলছে, সেই সাথে কিছু আবর্জনা তৈরি হচ্ছে, কিছু যন্ত্রপাতি ভেঙে যাচ্ছে, কিছু মেশিন নষ্ট হচ্ছে। সেগুলো সারাতে হবে। এই কাজটা কোষ নিজেই করে থাকে। নিজেই করে অটোফেজি নামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অকার্যকর ক্ষতিকর জিনিস গুলি রিসাইকেল করে অর্থাৎ আমার ব্যবহারের যোগ্য করে তোলে। কোষকে সতেজ হতে সাহায্য করে। শরীরের তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই প্রক্রিয়া ঠিকভাবে না হওয়ার সাথে ব্রেইনের বিভিন্ন রোগ যেমন অলসাইমার্স যে রোগে বয়স্করা ভুলে যেতে থাকে, আবোল তাবোল বলে।
তারপর পারকিনসন্স এই রোগগুলোর সম্পর্ক থাকতে পারে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আমরা যখন সারাক্ষণ খাওয়ার মধ্যে থাকি এই অটোফেজি প্রক্রিয়া দমে থাকে। অন্যদিকে রোজা রাখা অবস্থায় অটোফেজি প্রক্রিয়া বেড়ে যায়। এই যে অনেকে একটু আশ্চর্যজনক মনে করেন। কারণ স্বাভাবিকভাবে মনে হয় খাবার না খেলে তো শরীরের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে রোজা অবস্থায় কোষগুলো মেরামতের কাজ বেড়ে যায়। রোজা ছাড়া অটোফেজি প্রক্রিয়া বাড়ানোর আরো উপায় আছে যেমন ব্যায়াম ইনটেনসিটি ইন্টারভেল ট্রেনিং অটোফেজি প্রক্রিয়া চালু করার জন্য ভালো ব্যায়াম। মাত্র দশ থেকে পনেরো মিনিটের ব্যায়াম। কিন্তু ঘাম ঝরানো ব্যায়াম। যারা একদমই ব্যায়াম করেন না তারা রমজান মাসে হালকা করে শুরু করতে পারেন। শরীরে যতটুকু কুলায় ততটুকুই করলেন।

২) মেটাবলিক সুইচ করে শরীরের চর্বি কমিয়ে ফেলা


আমাদের শরীরের চালানোর জন্য ফুয়েল বা জ্বালানীর প্রয়োজন হয়। শরীর সেটা খাবার থেকে বা আগে থেকে জমিয়ে রাখা গ্লাইকোজেন বা এক প্রকারের চিনি থেকে নিয়ে থাকে। আমরা যখন রোজা রাখি তখন সাধারণত ১০-১২ ঘন্টা এমনি এই ফুয়েল শেষ হয়ে আসে। আমাদেরকে চালানোর জন্য শরীরকে তখন আগে থেকে জমানো চর্বি তে হাত দিতে হয়। এটাকেই বলে মেটাবলিক সুইচ। মেটাবলিক সুইচ অর্থাৎ চিনি থেকে সুইচ করে চর্বিতে আসা। আমি অনেক কঠিন একটা প্রক্রিয়া কে ছোট করে বললাম। সাম্প্রতিক সময়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে এই সুইচ এর ফলে আমাদের শরীর স্বাস্থ্যের বেশ কয়েকটি উপকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের হার্ট ভালো রাখা, পেটের চর্বি কমানো, ব্লাড প্রেসার কমা, রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসা সহ বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। তবে রোজা ভেঙেই আমরা কিছু কাজ করি যা হার্টের জন্য ক্ষতিকর। সেটা বাজার থেকে কিনে আনা ভাজা-পোড়া খাওয়া। এগুলোতে ট্রান্সফ্যাট থাকার সম্ভাবনা আছে যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ২০২০ সালের একটা গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার হোটেল, রেস্তোরা, বেকারিতে ব্যবহৃত পিএইচ বা ডালডার ৯২%  অতিরিক্ত মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট আছে।এই ট্রান্সফ্যাট হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড, অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ করা খাবার গুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন। রোজার মাসটাতে দেখা যায় আমরা ভাজা-পোড়া আরো বেশি করে খায়। রাস্তার দুই পাশের লাইন ধরে অনেক মুখরোচক ইফতার তৈরি থাকে। সাথে একটা উৎসবের আমেজ আসে। কিন্তু রোজা রেখে শরীরের উপকার হচ্ছে সেটা ধরে রাখতে চাইলে এগুলো কষ্ট করে এড়িয়ে যেতে হবে।


৩) পেটের স্বাস্থ্য ভালো হওয়া | রোজা রাখার উপকারিতা


আমাদের নাড়ি-ভুঁড়ি তে অনেক অনেক জীবাণুর বসবাস।যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ আরো অনেক ভাবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। না খেয়ে থাকলে আমাদের নাড়ি-ভুঁড়ি তে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বাড়ে অর্থাৎ রোজা রাখলে এইখানেও উপকারিতা আছে। উপকারি জীবাণু একটু সাহায্য করার জন্য কিমচি , আঁশ জাতীয় খাবার খেতে পারেন। 


৪) ওজন কমানো | রোজা রাখার উপকারিতা


বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশের গবেষণা একত্র করে দেখা গেছে রমজানের রোজার পরে গড়ে এক থেকে দেড় কেজি ওজন কমে। এটা গড় হিসেব অর্থাৎ কারো ওজন এর থেকে বেশি কমে, কারো ওজন বৃদ্ধি পায়। তবে সব একসাথে মিলে দেখা যায় যে ওজন কমেছে।


৫) রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ  | রোজা রাখার উপকারিতা


রক্তে সুগারের মাত্রা থেকে বোঝা যায় পরবর্তীতে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কেমন। নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি সুগার থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। রোজা রাখলে এ ক্ষেত্রেও উপকার পাওয়া যায়। তুরস্কের গবেষকরা ইরান, মিশর সহ আরো কয়েকটি দেশের করা ১৬ টা গবেষণা একত্র করে দেখেছেন রমজানের রোজা রাখার পরে নারী-পুরুষ উভয়ের রক্তে সুগারের মাত্রা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। আরেকটা আলাদা গবেষণায় ইন্দোনেশিয়ার গবেষকেরা ২৮তা গবেষণা একত্র করে দেখেছেন রমজানের রোজা রাখার ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও উন্নতি হয়েছে। তবে যারা ডায়াবেটিস রোগী ঔষধ খাচ্ছেন রোজা রাখলে ঔষধ কিভাবে চালিয়ে যাবেন সেটা আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ আরো কিভাবে বাড়ানো যায় যারা রিফাইন কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ সাদা চালের ভাত, সাদা আটার রুটি খান তারা এটা পাল্টে হোল গ্রীন খাওয়া শুরু করুন অর্থাৎ লাল চাল ,ঢেঁকিছাটা চাল বা ব্রাউন রাইস যেটাকে বলে। লাল আটার রুটি খেতে পারেন প্যাকেটের গায়ে লেখা দেখবেন ব্রাউন আটা বা হোল গ্রিন।


৬) রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ | রোজা রাখার উপকারিতা


আমাদের রক্তে এক প্রকারের চর্বি থাকে যাকে বলে কোলেস্টেরল। কোলেস্টেরল অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। রক্তনালিতে যার ফলে চর্বি জমে নালী সরু হয়ে যেতে পারে ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। রমজানের রোজার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে। আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরবের গবেষকেরা সারাবিশ্বে ৯ টা গবেষণা     একত্র করে দেখেছে যে রমজান মাসের রোজাই কোলেস্টেরল আর মাত্রা আগের চেয়ে ভালো নিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেও ৩ টা গবেষণা অন্তর্ভুক্ত আছে। রোজার পাশাপাশি আর কি করলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। একটা খুব ভালো কাজ হচ্ছে খাবারে আনসেটট্রে ফ্যাট পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। কোন কোন খাবারে এই ফ্যাট থাকে বিভিন্ন প্রকারের বাদাম যেমন কাঠ বাদাম, চিনাবাদাম ,হেইজল নাট , পিকান ,ওয়াল নাট  বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি কুমড়ার বীজ , তিলের বীজ তৈলাক্ত মাছ যেমন ইলিশ , কৈ , মলা ,চাপিলা , অলিভ অয়েল। বাইরে থেকে কেনা ভাজাপোড়া বাদ দিয়ে বাসায় রান্না করা খাবার তৈলাক্ত মাছ, বাদাম, বীজ এই খাবারগুলো খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে|


৭) ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ | রোজা রাখার উপকারিতা


২০১৯ সালে লন্ডনে পাঁচটা মসজিদে একটা গবেষণা হয় নাম লন্ডন রমাদান স্টাডি। রমজানের আগে পরে ব্লাড প্রেশার মেপে দেখা হয় কোন পরিবর্তন হয়েছে কি না। সেটা দেখা গেল সিস্টোলিক প্রেসার অর্থাৎ ব্লাড প্রেসার প্রথম বা  উপরের সংখ্যা কমেছে ৭মিলিমিটার মার্কারি দ্বিতীয় সংখ্যা কমেছে তিন মিলিমিটার মার্কারি। ভারত, পাকিস্তান, কাতার সহ অন্যান্য দেশে এমন আরো ৩২ গবেষণা একসাথে করে দেখা গেছে রমজানের রোজার প্রেসার নিয়ন্ত্রণে আসে ওজন না কমলে। সেহরি ও ইফতারের বেশি করে ফলমূল ও সবজি খেলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে আরো উপকার পাবেন।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন